বিছানায় বসে বসে চা খাচ্ছিলাম। ঠিক এমন সময় আমার সাত বছরের বাচ্চা মেয়ে আরশিতা বললো-
"পাপা তুমি যেটা দিয়ে হিসু করো ওইটা কি কোনো ছোট মেয়েকে খাইয়েছো? ওটা খেতে কি চকলেটের মতো"?
আরশিতার
মুখে কথাটা শুনে আমার বুকটা ধুক করে উঠলো৷ হাতে থাকা চায়ের কাপটা মাটিতে
পড়ে গেলো। কি বললো আমার মেয়ে? আমি এখনো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিনা।
আরশিতার দিকে একবার তাকালাম, একটু আগে আমাকে কতো বড় প্রশ্ন জিজ্ঞাস করেছে
সেদিকে তার একটুও খেয়াল নেই। খুব মনোযোগ দিয়ে খেলা করছে।
আমি এই বিষয়ে ওর সাথে আর কোনো কথা বললাম না।
কিন্তু আরশিতার মনের ভিতর এই প্রশ্নটা আসলো কিভাবে?
আমি
আমার মেয়েকে মোবাইল বা ল্যাপটপ স্পর্শ করতে দেইনা, তাই ইন্টারনেটে দেখার
কোনো সুযোগ নেই। আর এতোটুকু মেয়ে ইন্টারনেটের কি'ই বা বুঝে? তাছাড়া আমি
আমার স্ত্রী মিহির সাথেও ওইধরনের কোনো নোংরামি করিনি, যেটা আরশিতা দেখে
ফেলবে।
তাহলে কি মিহি অন্য কারো সাথে পরকীয়া করে? আরশিতা কি সেটা দেখে ফেলেছে?
ছিঃ ছিঃ। কি নোংরা কথা ভাবছি আমি। মাথা থেকে আরশিতার কথাটা সরানোর চেষ্টা করলাম।
পরেরদিন
সকালে টেবিলে বসে চা খাচ্ছি, কিন্তু বারবার আরশিতার বলা কথাটা মাথায়
ঘুরপাক খাচ্ছে। এতোটুকু মেয়ের মনের ভিতর ওই টাইপের প্রশ্ন? কিভাবে সম্ভব??
আমাকে আনমনা দেখে মিহি জিজ্ঞাস করলো-
-আজকে থানায় তোমার কাজ নাই মেহরাব? অন্যদিন তো খুব তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে যাও"।
মিহির দিকে একবার বিষ্ময় চোখে তাকালাম। বললাম-
-কেনো? আমি চলে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছো না'কি? আমি চলে গেলে ভালো হয়"?
-কি আজব কথাবার্তা। এমনভাবে বলছো কেনো"?
মিহির প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে বের হয়ে গেলাম।
থানায়
এসে কাজে একদম মন বসাতে পারছিনা। আমার সামনেই গতকাল রেপ হয়ে মারা যাওয়া
একটা মেয়ের পোস্টমোর্টেম রিপোর্ট পড়ে আছে। আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা করছেনা
সেটা খুলে দেখতে।
একটা বুড়ো লোককে দেখলাম কাঁদতে কাঁদতে কমপ্লেইন লিখাচ্ছে। অন্যদিন হলে নিজেই গিয়ে জিজ্ঞাস করতাম
"কি হয়েছে"?। কিন্তু আজকে আমার নিজের মনেই শান্তি পাচ্ছিনা। বারবার আরশিতার প্রশ্নটা কানে বাজছে।
আমার
রীতিমতো মিহিকে সন্দেহ হচ্ছে। আমি জানি আমি উল্টাপাল্টা ভাবছি, কিন্তু
মাথা থেকে কোনোভাবেই এসব নোংরা চিন্তাগুলো ফেলে দিতে পারছিনা।
বাসায় ফেরার সময় গেইটের কাছে এসে থামলাম। দারোয়ান করিমকে বললাম-
-আমি থানায় যাওয়ার পর বাসায় কে কে আসে"?
প্রশ্নটা শুনার জন্য করিম হয়তো প্রস্তুত ছিলোনা। মাথা নিচু করে বললো-
-কই কেউ আহেনা তো স্যার"।
আমি ঠাসসসস করে ওর গালে একটা থাপ্পড় মারলাম।
-সত্যি করে বল আমি থানায় যাওয়ার পর বাসায় কেউ আসে কি'না"?
বুঝতে পারলাম করিম রীতিমতো ভয় পাচ্ছে। আমতা আমতা করে বললো-
-আপনে থানায় যাওয়ার পর, আর আরশিতা মামণি ইসকুলে যাওয়ার পরে দুইদিন একটা ছেলে আইছিলো ম্যাডামের লগে দেহা করতে"।
-ছেলে? কেমন ছেলে? বয়স কতো"?
-এই ধরেন স্যার ছব্বিশ পছিশ হইবো"।
কথাটা শুনে অনুভব করলাম হৃদপিণ্ডে ধড়াম ধড়াম আওয়াজ হচ্ছে। কেউ হাতুড়ি পিটা করছে। করিমকে জিজ্ঞাস করলাম-
-আরশিতা স্কুলে যাওয়ার পর তোর ম্যাডাম কি কখনো বাইরে যায়"?
- হ যায়তো স্যার, ম্যাডাম তো প্রায়ই একলা যাওয়োন আহোন করে"।
করিমের সাথে এই বিষয়ে আর কোনো কথা বাড়ালাম না। বাসায় এসে মিহির সাথেও ওইদিন আর কোনো কথা বলিনি"।
পরেরদেন সকালে নাস্তা করে বাসা থেকে বের হলাম। রাস্তার মোড়ে একটা চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি মিহি বের হয় কি'না দেখার জন্য।
ঘন্টাখানেক পর মিহি বের হলো। খুব সুন্দর করে সাজুগুজু করেছে।
একটা রিক্সা ডাক দিয়ে রিক্সায় উঠলো মিহি, আমিও পিছন পিছন একটা রিক্সা নিলাম।
একটা
পার্কের কাছে গিয়ে মিহি রিক্সাটা থামালো। দেখলাম একটা যুবক ছেলে বসে আছে।
হয়তো মিহির জন্য অপেক্ষা করছে। মিহি গিয়ে ওর কাছে বসলো৷ ছেলেটা মিহির হাত
ধরা মাত্রই আমার মেজাজটা এত্ত বেশি খারাপ হলো, নিজের রাগটা আর কন্ট্রোল
করতে পারলাম না।
ওদের কাছে গিয়ে প্রথমেই ছেলেটাকে দুই তিনটা কানের নিচে থাপ্পড় মারলাম।
মিহির চেহারা একদম ভীত হয়ে গেছে।
মিহির
গালেও ঠাসস করে থাপ্পড় মারলাম। এই প্রথম, এই প্রথম আমি আমার ভালোবাসার
মানুষটার গায়ে হাত তুলছি৷ অবশ্য ভালোবাসার মানুষ বলতেও এখন লজ্জা লাগছে।
মিহিকে ছোট করে একটা প্রশ্ন করলাম-
- তুমি এসব পাপ কাজ করছো করো। কিন্তু আরশিতার সামনে কেনো"?
মিহি কান্না করছে, অবিরাম কান্না করছে। একিই সাথে চেহারায় স্পষ্ট দেখতে পেলাম মিহি ভীষন অবাক হয়েছে। কান্না করতে করতে বললো-
-মেহরাব
আমি নিরুপায় ছিলাম। আমার কিছু করার ছিলোনা। রাহাত আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে
আমার সাথে দেখা করতে চাইতো। কিন্তু আমি ওর সাথে কোনো পাপ কাজ এখনো করিনি৷
আরশিতার সামনে করার তো কোনো প্রশ্নই আসেনা"।
বুঝতে পারলাম ছেলেটার নাম রাহাত।
কিন্তু আমি এখনো জানিনা ছেলেটা কিভাবে কিসের জন্য মিহিকে ব্ল্যাকমেইল করছে।
আমার মাথায় স্রেফ ৪টা কথা ঢুকলো।
"আমি নিরুপায়"
"আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছে"
"পাপ কাজ এখনো করিনি"
"আরশিতার সামনে অবশ্যই না"।
এই ৪টা কথা আমাকে ঘুরেফিরে আমার মেয়ের প্রশ্নের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
মিহিকে এসব করতে না দেখলে আরশিতার মাথায় ওই প্রশ্নটা আসলো কিভাবে???
মিহিকে জিজ্ঞাস করলাম-
-তোমাকে ব্ল্যাকমেইল করে মানে? তুমি এই ছেলেকে কতোদিন ধরে চিনো"?
মিহি কান্না জড়িত কন্ঠে বললো-
-ওর
নাম রাহাত। ৪মাস আগে ওর সাথে আমার ফেসবুকে পরিচয়। আমি ওরে ভালো একটা
ফ্রেন্ড মনে করেছিলাম মেহরাব। বিশ্বাস করে আমার দুই একটা পিক দিছিলাম। আর
এখন এগুলো ইডিট করে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে দেখা করতে চায়"।
মিহির কথা শেষ হবার পর আমি কিছু বলার আগে ছেলেটা বললো-
-চার
মাস না স্যার, চার বছর। চার বছর ধরে আমি মিহিকে ভালোবাসি। সেই কলেজ লাইফ
থেকে। আমি'তো বেশি কিছু চাইনা স্যার, আমি শুধু মিহিকে প্রতিদিন একবার দেখতে
চাই, ওর কন্ঠটা একটাবার শুনতে চাই"।
কথাটা শুনে মিহি অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকালো, বুঝতে পারলাম মিহি এসবের কিছুই জানেনা। একটা না বলা ভালোবাসার গল্প।
আমার মনে হলো "ছেলেটা তো ভালোবেসেছে, ওকে আর মারাটা ঠিক হবেনা"। ছেলেটাকে বুঝিয়ে বললাম-
"বিয়েটা
তো উপরওয়ালার হাতে, কার সাথে কার বিয়ে হবে সেটা কেউই বলতে পারেনা। এখন
যেহেতু মিহির বিয়ে হয়েই গেছে, তো তোমার উচিত এখন ও যেনো ভালো থাকে এটা দোয়া
করা। ওকে আর ডিস্টার্ব না করা"।
আমার কথাটা শুনে ছেলেটা বুঝতে পারলো। আমি মিহিকে নিয়ে বাসায় চলে আসলাম"।
একে
তো আমার মাথায় সারাদিন আরশিতার বলা কথাটা ঘুরপাক খেতে থাকে, তার উপর আবার
মিহির এই কান্ড, আমি একদম নিতে পারছিলাম না এসব। মিহিকে ডাক দিয়ে বললাম-
-আমার মনে'হয় তুমি কিছুদিন তোমার বাবার বাড়ি থেকে ঘুরে আসো। আমি কয়েকটা দিন একলা থাকতে চাই"।
মিহি কিছু সময় চুপ করে রইলো। তারপর বললো-
-আমি আরশিতাকেও সাথে করে নিয়ে যাই"?
-নাহ, আরশিতা আমার কাছেই থাকুক। এই কয়েকদিন আরশিতাকে নিয়ে স্কুলে যাওয়া আসা আমিই করবো"।
মিহি আমার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো। হয়তো বুঝতে পেরেছে আমি কোনোকিছু নিয়ে টেনশনে আছি।
কোনো কথা না বলেই রুমে চলে গেলো ব্যাগ গুছাতে"।
পরেরদিন সকালে আরশিতাকে রেডি করাচ্ছিলাম স্কুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আরশিতা বললো-
-পাপা আমি স্কুলে যাবোনা"।
-কেনো মামনী? আজকে আম্মু রেডি করিয়ে দিচ্ছেনা বলে"?
-নাহ পাপা, তুমি তো বলেছো আম্মু এক দুইদিনের ভিতরে চলে আসবে।
কিন্তু পাপা পলাশ টিচারটা আমাকে অনেক মারে, আমি ব্যাথা পাই"।
আমি আরশিতার কপালে একটু চুমু খেলাম। বললাম-
-হোমওয়ার্ক
না করে গেলে টিচার তো মারবেই, তাইনা? তারপরেও আমি পলাশ টিচারকে খুব করে
বকে দিবো আজকে, ওনার কতো বড় সাহস ওনি পুলিশের রাজকন্যাকে মারেন।
কিন্তু হোমওয়ার্কটা ঠিকঠাক মতো করতে হবে। ঠিক আছে মামনী"?
আমার কথা শুনে আরশিতা হাসলো৷ একটা বাচ্চার হাসি, নিষ্পাপ হাসি, পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর হাসি।
আরশিতাকে
স্কুলে নামিয়ে দিয়ে থানায় গেলাম। বারবার মাথায় একটাই প্রশ্ন আসছিলো "এতোটা
নিষ্পাপ আমার মেয়ে, এই নিষ্পাপ মেয়েটার মাথায় ওই প্রশ্নটা আসলো কিভাবে"?
সদ্য
রেপ হয়ে মারা যাওয়া মেয়েটার ফাইল খুললাম, জানোয়ারের মতো মেয়েটাকে মেরেছে
ওরা। প্রথমে রেপ, তারপর লজ্জাস্থানে ছুরি দিয়ে আঘাত, হাত পায়ের আঙুল কাটা,
উফফফ।
কতোটা যন্ত্রণার মৃত্যু। মেয়েটা নিখোঁজ হওয়ার ৫দিন পর আমরা মেয়েটার লাশ পাই।
কেসটা নিয়ে কাজ করা শুরু করলাম। আমার মাথায় ই ছিলোনা আরশিতাকে স্কুল থেকে নিয়ে আসতে হবে।
প্রায়
আধঘন্টা দেরি হয়ে গেলো। তাড়াহুড়ো করে আরশিতার স্কুলে গেলাম। সব বাচ্চারা
ইতিমধ্যেই চলে গেছে, আরশিতাকে কোথাও দেখতে পেলাম না। চারিদিক খুঁজলাম,
আরশিতা নেই।
আরশিতার টিচার পলাশকে দেখলাম স্কুল থেকে বের হতে। দৌড়ে গেলাম ওনার কাছে। বললাম-
-পলাশ ভাই আরশিতা কোথায়"?
-আরে মেহরাব স্যার আপনি? আরশিতা কোথায় মানে কি? স্কুল তো ত্রিশ মিনিট আগেই ছুটি হয়ে গেছে। আর আজকে আপনি কেনো আসলেন? ভাবি কোথায়"?
আমি পলাশের কোনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো অবস্থায় ছিলাম না। স্কুল থেকে বের হয়ে আশপাশের সব দোকান খুঁজলাম, আরশিতা নেই।
আমার
ভিতরটা দুমড়েমুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। হুট করে আমার মনে হলো মিহি হয়তো
আরশিতাকে নিয়ে গেছে, একরাত মেয়েকে দেখেনি হয়তো তাই। মিহিকে কল দিলাম-
-হ্যালো মিহি, আরশিতাকে তুমি নিয়া গেছো স্কুল থেকে"?
-মানে? তুমি না আমাকে বললে স্কুল থেকে আনা নেওয়া কয়েকদিন তুমি করবে"।
আমি বুঝতে পারলাম মিহি কিছুই জানেনা। মিহিকে আর কিছু বলতেও চাইলাম না, টেনশন করে মারা যাবে একদম।
মিহি ওপাশ থেকে চিল্লায়া উঠলো-
-মেহরাব আমার মেয়ে কোথায়য়য়"?
আমি চুপ করে রইলাম।
মিহি এবার কান্না করতে করতে আরো জোরে বললো-
-মেহরাব কথা বলোওওওওও। আরশিতা কোথায়য়য়"?
আমি আস্তে করে বললাম-
-আরশিতাকে খুঁজে পাচ্ছিনা মিহি। স্কুলে ওকে নিতে এসে দেখি আরশিতা নেই। তুমি চিন্তা করিওনা, আমি আরশিতাকে খুঁজে বের করবো"।
মিহি ওপাশ থেকে জোরে জোরে কান্না করতে থাকলো। আমি ফোনটা কেটে দিলাম।
তাড়াতাড়ি
থানায় আসলাম। প্রত্যেকটা থানায় আরশিতার ছবি মেইল করে বললাম যাতে বাস
স্ট্যান্ড, সবগুলো পয়েন্ট, চেক করে তারপর যেনো গাড়ি ছাড়ে। বাসার দারোয়ান
করিমকে কল দিলাম, বললাম "আরশিতা বাসায় আসলে আমাকে আর মিহিকে যেনো তাড়াতাড়ি
কল দেয়"।
আমার মাথায় কোনোকিছু কাজ করছিলো না। হুট করে কি হয়ে গেলো?
একদিকে
আরশিতাকে খুজে পাচ্ছিনা, অন্যদিকে রেপ হওয়া মেয়েটার খুনিরাও দিব্যি ঘুরে
বেড়াচ্ছে। ওই মেয়েটাও কলেজের সামনে থেকে কিডন্যাপ হয়েছিলো"।
চলবে......
0 Comments:
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।