আমার গার্লফ্রেন্ড সেজুতি ফোন দিয়ে বলতেছে, 'জানো, স্বর্ণার বয়ফ্রেন্ড ওকে আইফোন গিফট করেছে। কিউট না?'
.
মানে তুমিও করো আমাকে। আমি কি আর কথার ভেতরের গোপন অর্থ বুঝিনা?
.
বললাম, 'দিবেই তো। স্বর্ণা নিয়মিত তার বফের সাথে রুমে যায়। তুমি আমার সাথে বারান্দায়ও আসো না। এই শীতের রাতে স্বর্ণা জামা খুলে ন্যুড পাঠায়। তুমি গরমকালে টিশার্ট পরা ছবিও দাও না।'
.
তো মেয়ে আমাকে ব্লক করে দিলো। রেগে গেছে। স্বাভাবিক। ন্যুডের খোটা দেয়া ঠিক হয়নি। এলাকার বিখ্যাত প্রেমিক মিজান ভাই সবসময় বলতো, 'গরীবকে ভাতের খোটা আর প্রেমিকাকে ন্যুডের খোটা কখনো দিতে নেই।'
সুতরাং এখন রাগ ভাঙানোর একটাই উপায়। সেটা হলো আইফোন কিনে নিয়ে যাওয়া। আধখাওয়া আপেল ছাড়া সেজুতির রাগ কোনোভাবেই আর ভাঙবে না। অথচ এই মুহুর্তে আমার পকেটে আছে সাতাশ টাকা। বাসায় যেতে রিক্সাভাড়াই লাগবে ত্রিশ টাকা। শীতের রাত, হেটে যেতেও ইচ্ছা করে না। তারপরও তের টাকা খরচ করে একটা বেনসন ধরিয়ে হাটা শুরু করলাম।
তবে ব্যাপারটা এমন না যে এখন নাই, বাসায় যাওয়া মাত্রই টাকার বাণ্ডিলে পকেট ভরে যাবে৷ আমার আয়ের একমাত্র উৎস এখন তালা দেয়া থাকে। আলমারির ড্রয়ার থেকে যে আমি টাকা সরাই এটা আম্মু জেনে গেছে। সুতরাং ঝুলছে তালা। আর সেজুতিকে কিভাবে ফোন কিনে দেব, আমি নিজেই টাকার অভাবে নষ্ট ফোন চালাচ্ছি। বেকার মানুষ, বাসায় টাকা চাইতেও পারি না। এদিকে চাকরিও পাওয়ার সম্ভাবনা দেখছিনা। এলাকার সবাই সেদিন পিকনিক করলো। দুইশো টাকা চাদা। আমি আস্তে করে বললাম, 'টাকা তো বিষয় না রে ভাইয়া, কিন্তু আজকেই আমাদের বাসায় গরুর মাংস আর মুরগির রোস্ট রান্না করেছে।'
তারপর চুপচাপ বাসায় এসে লাউ ভাজি আর ডাল দিয়ে ভাত খেলাম।
জানি এলাকায় আমাকে নিয়ে হাসাহাসি হয়৷ সবাই বলে, 'পিকনিক করলেই সোহাইল ভাইয়ের বাসায় মাংস রান্না হয়। ছ্যাচড়া দেখছি, এরকম দেখিনাই।'
.
আম্মু দিনে দুইবার কানের কাছে এসে গল্প শোনায়। অমুকের ছেলে বেতন পেয়ে তার মাকে কানের দুল কিনে দিয়েছে।
মানে তুমিও চাকরি পেয়ে কিনে দাও আমাকে। আমি কি আর কথার ভেতরের অর্থ বুঝি না?
.
আব্বু আমাকে মুখে কিছু বলে না কিন্তু কাজে বুঝায়। আমার সাথে ঠিকমত কথাই বলতে চায় না। বোন আমার পিচ্চি ভাগ্নেকে কোলে দিয়ে বলে, যাও, মামা দোকান থেকে আইসক্রিম কিনে দেবে।
আরে বাল আইসক্রিম কিনতেও তো পঁচিশ টাকা লাগে। তোর লাটসাহেব পোলা তো দুই টাকার সকাল সন্ধ্যা খায় না। কোণ চায়।
এদিকে এলাকার এক দোকানদার, যার থেকে বাকি নিতাম। সে দোকানে পোস্টার ঝুলাইছে, 'আজ থেকে এক মাস বাকি বিক্রয় বন্ধ।'
আচ্ছা আমি একমাস কোনোমতে ওয়েট করছি, কিন্তু এ কি অবস্থা। একমাস পরও সেই পোস্টার সেখানেই ঝুলছে। পরের মাসেও সেম অবস্থা। তার পরের মাসেও। বাকি চাইলেই দেখায় দেয়, 'আজ থেকে এক মাস বাকি বিক্রয় বন্ধ।'
.
কি একটা লাইফ হ্যাক! এক মাস আর শেষ হবেনা জীবনে। এতো বুদ্ধি নিয়ে দোকানদারি করে, হওয়ার কথা ছিলো এমপি মন্ত্রী।
.
এসব ভাবতে ভাবতে এই শীতের রাতে হেটে হেটে বাসায় ফিরছি। সিগারেটও শেষ। আরেকটা ধরাবো কিনা ভাবতেছি। কিন্তু আশেপাশে দোকানও নেই। পুরো ফাকা রাস্তা। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় যতদূর চোখ যায় কেউ নেই। এই সুযোগে দুইটা কুকুর প্রেম ভালোবাসা করতেছে। এটা কি ভাদ্র মাস? কই যেন শুনেছিলাম কুকুররা খালি ভাদ্র মাসে সেক্স করে। তাইলে বৈশাখ মাসে ফিল আসলে কি করে? কুকুরের গার্লফ্রেন্ড মাথা নেড়ে বলে, এখন না ভাদ্র মাসে হবে। তারপর করো ছয় মাস ওয়েট। সেজুতিও যেমন আমাকে বলে, এখন না বিয়ের পরে।
ওদের তো তাও সর্বোচ্চ এক বছর। আর আমার বিয়ে কবে হবে কোনো ঠিক আছে?
আচ্ছা কুকুরের গার্লফ্রেন্ডরাও কি বলে, 'অমুক কুকুর তার প্রেমিকারে ছাগলের ডান রানের হাড্ডি গিফট করেছে। কিউট না?'
.
আমার পায়ের শব্দে কুকুর দুটো দৌড়ে চলে গেল। তখন আমি দেখলাম রাস্তায় একটা ব্যাগ পড়ে আছে। স্কুল ব্যাগের মতই, কিন্তু একদম নতুন। চকচকে। আর দেখেই বোঝা যাচ্ছে দামি ব্যাগ। ভেতরে কি আছে? বোমা টোমা হবে না তো? কিন্তু ভয়ের থেকে বেশি কৌতুহল জিতে গেল। সাবধানে ব্যাগের চেন একটু ফাকা করে যা দেখলাম তাতে আমার নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার যোগাড়। ব্যাগ ভর্তি শুধু এক হাজার টাকার বান্ডিল। ওহ মাই গড। এটা কি দেখছি আমি? স্বপ্ন নাকি সত্যি। প্রচন্ড শীতের মধ্যেও খেয়াল করে দেখি আমার গায়ে ঘাম। চুপচাপ ব্যাগটা কাধে নিয়ে হাটা শুরু করলাম। আমাদের বাসা এখান থেকে আর মাত্র আধা কিলোমিটার।
.
রুমে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিলাম। ব্যাগের চেন খুলে বিছানার ওপর উপুড় করতেই ঝরঝর করে টাকা পড়লো। সব এক হাজার টাকার বান্ডিল। গুনে দেখলাম একশোটা বাণ্ডিল। মানে এক কোটি টাকা। ফাক ম্যান, আমি তো কোটিপতি। টাকাগুলো বিছানায় পাশাপাশি সাজালাম। আজ আমি টাকার বিছানায় ঘুমুবো। সাজাতে গিয়েই খেয়াল করলাম একটা বান্ডিল অন্যগুলোর তুলনায় চিকণ। গুণে দেখি আশিটা নোট। তার মানে বাকি বিশ হাজার টাকা কেউ একজন খরচ করে ফেলেছে? শীট, একটুর জন্য কোটিপতি হওয়া হলো না। লাখপতি থেকে গেলাম। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। ধুর! কি এমন হতো ঐ বিশ হাজার কম না থাকলে। টাকার মালিক এখান থেকেই কেন খরচ করতে গেল? বিশ হাজার টাকা কি তার কাছে আলাদা ছিলো না? কান্না আসলো আমার। বিশ হাজার টাকা কি কম! রাতে ঘুম হলো না ঠিকমত। বারবার মনে হচ্ছে ভুল দেখেছি। এক কোটি টাকাই আছে। ধড়ফড় করে উঠে আবার গুণে দেখি। নাহ, নিরানব্বই লাখ আশি হাজার টাকা। ইস! আমার সাথেই কেন এমনটা হতে হলো। কি দোষ ছিলো আমার। আমার আসলে ভাগ্যটাই খারাপ। ভাগ্য খারাপ নাহলে নিশ্চয় বিশ হাজার টাকা কম থাকতো না।
.
একবার ভাবলাম পুলিশের কাছে যাই। টাকা কম থাকবে ফাজলামি নাকি। ব্যাগের মালিকের নামে প্রতারণার মামলা ঠুকে দিলে একদম উচিত শিক্ষা হবে।
পরক্ষণেই আমার সিক্সথ সেন্স বললো, কেস করতেও টাকা লাগে। তারপর যদি পুলিশ ঘুষ চায়? সেক্ষেত্রে যাবে আরো দশ হাজার। আর তাছাড়া কেস করবই বা কার নামে। ব্যাগের মালিককে তো চিনিনা।
ব্যাগের সব পকেট আতিপাতি করে খুজলাম৷ কোনো ঠিকানা পেলাম না। পেছনের ছোট এক প্যাকেটে ভাংতি আরো আশি টাকা আর একটা এলপেনলিভ চকলেট পেলাম৷
আমি শিওর কোনো দোকানদার একটাকা ভাংতি না দিয়ে চকলেট দিয়েছে। আবারো মেজাজ গরম হয়ে গেল। ঐ এক টাকা থাকলেও একাশি টাকা হতো। চকলেট দিয়ে আমি কি করব, আমি কি বাচ্চা নাকি।
.
পরদিন সকালে খাতা কলম নিয়ে লিস্ট করতে বসলাম। একটা আইফোন এক্স আশি হাজার টাকা। স্বর্নের কানের দুল চল্লিশ হাজার৷ ভাগ্নের চকলেট ফ্লেভারের কোণ আইসক্রিম পয়তাল্লিশ টাকা। মুদিখানায় বাকি পায় আঠারোশো আর এলাকার নেক্সট পিকনিকে দুইশো। মোট এক লক্ষ বাইশ হাজার পয়তাল্লিশ টাকা। নাহ, মেলা পড়ে যায়। আরবকটু কমাতে হবে। মনে পড়লো সেজুতি শুধু আইফোন বলেছে, এক্স বলেনি। তারমানে যেকোনো মডেল হলেই হবে৷ আইফোন ফাইভ কেমন হয়? এতো পুরাতন মডেল নতুন পাওয়া যাবেনা এখন আর। বিক্রয় ডট কমে গিয়ে দেখি ছয় হাজার টাকায় এড দেয়া। হ্যা, এটাই দেয়া যায়। স্বর্ণের দোকানে খোজ নিলাম। সবচাইতে কম দামে বেশি করে খাদ দিয়ে দুইটা দুল বানানো যাবে বারো হাজারে। আর ভাগ্নেকে ফ্লেভার ছাড়া মিনি কোণ দিলে কুড়ি টাকাতেই হচ্ছে। মুদিখানার দোকানে সব না দিয়ে এক হাজার দিলেই খুশি হবে৷ আপাতত আর চাইবে না। আর পিকনিকে আমি গরু খাইনা এলার্জি আছে শুধু মুরগি খাবো বলে একশো টাকা দিলেও হয়।
.
তাহলে খরচ আসতেছে উনিশ হাজার একশো কুড়ি টাকা। শিট, ঐ বিশ হাজার থাকলে ওর মধ্যেই হয়ে যেত৷ কেন যে লোকটা টাকাগুলো খরচ করতে গেল। ইস!
.
লাস্ট মোমেন্টে অবশ্য খরচ আরেকটু কমলো। বিক্রয় ডট কমে একটা আইফোন থ্রি পাওয়া গেছে। ডিসপ্লে সামান্য ফাটা আর চার্জার পয়েন্টে সমস্যা। দাম আঠারোশো টাকা। দামাদামি করায় ষোলশতে রাজি হয়েছে। আম্মু বলেনি কিসের কানের দুল। সোনার বদলে ইমিটেশন দিলেই দাম আসে মাত্র চারশো টাকা। পিকনিক করার দরকার কি, বাসায় মাঝে মাঝে মাংস এমনিতেই রান্না হয়। এই শীতে ভাগ্নেকে আইসক্রিম না খাওয়ানোই বেটার। ব্যাগে পাওয়া চকলেটটা দিয়ে কাজ চালানো যাবে। আর মুদিখানার দোকানকদারকে টাকা না দিয়ে একটা কাগজে লিখে দিয়াসব, 'এই মাসটা গেলেই সমস্ত বাকি পরিশোধ করা হবে।'
.
আইফোন থ্রি কিনতে যাব, ব্যাগ থেকে টাকা বের করলাম। কিন্তু হাজার টাকার চকচকে নোটগুলো খরচ করতে ইচ্ছা হলো না। আইডিয়া পেলাম। ফোন তো আমারো কেনা লাগবে, সুতরাং আমার নিজের ফোনটা ছয় হাজারে বিক্রি করে দিলাম। আমার ফোন পরে কিনলেই হবে। ছয় হাজার খরচ করে সবকিছু করলাম লিস্ট অনুযায়ী। আরো টাকা বেঁচে গেল। শুধু মুদিখানায় বুদ্ধি কাজে লাগেনি। এক হাজার টাকা দেয়া লাগছে। এটাই গেছে হিসাবের বাইরে।
.
সেজুতি প্রায় নষ্ট আইফোন থ্রি আমার সামনে আছাড় দিয়ে ভেঙে ব্রেকাপ করে চলে গেছে। আম্মু কানের দুলটা কিছুক্ষণ দেখে আমার সামনেই কাজের মহিলাকে দিয়ে দিলো। কাজের মহিলা দুল হাতে নিয়ে বলেছে, 'এইসব আমরা পরিনা ভাবী। ফুটপাতে ত্রিশ টাকায় পাওয়া যায়। আমার বর আমাকে রুপোর দুল দিছে। এইটা আপনিই রাখেন।'
ভাগ্নে চকলেট হাতে নিয়ে ছুড়ে ফেলে বলেছে, 'আমি ডেইরি মিল্ক খাবো।'
এলাকার পোলাপান বাসায় মাংস রান্নার গল্প শুনে মুখ টিপে হেসেছে।
.
অথচ এরা কেউ জানেনা আমি প্রায় কোটিপতি। জানলে কি করত আল্লাহই জানে।
.
আমি আপাতত ফোন ছাড়াই চলতেছি। টাকা খরচ করতে ইচ্ছা করে না। কি সুন্দর নতুন টাকা। উলটা আমি আরো টাকা জমাচ্ছি। কুড়ি হাজার জমালেই কোটিপতি হতে পারব।
.
বেকার মানুষ, কুড়ি হাজার টাকা কই পাই? আইডিয়া আসলো। একটু বেশি টাইম লাগলেও, আশা করা যায় কাজে দিবে। শুরু করলাম।
.
.
পরিশিষ্টঃ টাকা ভরা ব্যাগ যেদিন পেয়েছিলাম সেদিনই জানতাম আমার লাইফ চেঞ্জ হয়ে যাবে। তারপর চার বছর কেটে গেছে। আক্ষরিক অর্থেই আমার লাইফ চেঞ্জ হয়ে গেছে। সকালে উঠে বাসে করে একেকদিন একেক এলাকায় যাই। তারপর মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলি, ছোট বোনের বিয়ে, আম্মা অসুস্থ, ভাইয়ের লেখাপড়া করার শখ, সাহায্য লাগবে। কেউ পাঁচ টাকা, কেউ দুই টাকা আবার কেউ চাউল দেয়। তিন বছর ধরে নিজের হাতখরচ বাদ দিয়ে দশ হাজার আটশো একুশ টাকা জমা হয়েছে। শীঘ্রই কোটিপতি হয়ে যাব আশা করা যাচ্ছে। আল্লাহ ভরসা!
লেখা: সোহাইল রহমান
0 Comments:
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।