প্রথম বিশ্বযুদ্ধের স্থায়িত্ব ছিলো চার বছরের কিছু বেশি। ১৯১৪ সালের ২৮
জুলাই শুরু হয়, শেষ হয় ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর। এই যুদ্ধে দুই কোটি মানুষ
নিহত হয় এবং দুই কোটি দশ লাখ মানুষ আহত হয়।
যুদ্ধের শেষ বছরের শুরুতেই, ১৯১৮ সালের জানুয়ারি মাসে, দেখা দেয় ভয়াবহ
ইনফ্লুয়েঞ্জা। যেটি পরে স্পেনিশ ফ্লু নামে পরিচিতি লাভ করে। স্পেনিশ ফ্লু
কিন্তু স্পেন থেকে আসেনি। প্রথম মহাযুদ্ধে নিরপেক্ষ দেশ ছিল স্পেন। যুদ্ধে
জড়িত সব পক্ষই রোগের প্রাদুর্ভাবের খবর লুকিয়ে রেখেছিল সৈনিকদের মনোবল ঠিক
রাখার জন্য। কিন্তু যেহেতু স্পেন ছিল যুদ্ধ নিরপেক্ষ দেশ, এর মিডিয়া ছিল
মুক্ত। ১৯১৮ সালের মে মাসে মাদ্রিদ এই ঘাতক ব্যাধির কথা প্রথম প্রচার করে। যেহেতু খবরটি স্পেন থেকে আসে তাই লোকে এর নাম দিয়ে দেয় স্পেনিশ ফ্লু।

কোত্থেকে এর উৎপত্তি হয়েছে তা নিয়ে নানান রকম মতভেদ আছে। আমেরিকার
আরকানসাস থেকে, ফ্রান্স থেকে, দক্ষিণ আমেরিকা থেকে এমন নানান রকম কথা এবং
গবেষণার ফলাফল বাজারে চালু আছে। যেখান থেকেই আসুক না কেন এটিও আজকের
করোনার মতোই অতিমাত্রায় ছোঁয়াচে এবং দ্রুত সংক্রমণশীল ছিল।
তখন এক ভূখণ্ড থেকে অন্য ভূখণ্ডে মানুষের আসা-যাওয়া তেমন সহজসাধ্য ছিল
না, তার পরেও এই অসুখটি পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ে। ১৯২০ সালের
ডিসেম্বর অব্দি এর স্থায়িত্বকাল ছিল। এই তিন বছরে পৃথিবীর প্রায়
এক-চতুর্থাংশ মানুষ (৫০ কোটি) এই রোগে আক্রান্ত হয় এবং প্রায় পাঁচ কোটি লোক
মারা যায়। মোট আক্রান্তের দশ শতাংশ মানুষ স্পেনিশ ফ্লুতে মারা যায়।
একশ বছর পরে আজকের পৃথিবী আবারও সেরকম একটি ভয়াবহ অতিসংক্রামক ফ্লুকে
মোকাবিলা করছে। একশ বছর আগে চিকিৎসা বিজ্ঞান উন্নত ছিল না, ছিল না উন্নত
যোগাযোগ ব্যবস্থা। ফলে পৃথিবীর কোথায় কত মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, কত মানুষ
মারা যাচ্ছে তা খুব সহজে এবং দ্রুত জানা যেত না। আমরা আশা করতেই পারি
করোনা স্পেনিশ ফ্লুর মতো ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারবে না। এখন প্রতি মুহূর্তে আমরা
আক্রান্তের খবর পাচ্ছি, কি করলে এর সংক্রমণ থেকে দূরে থাকা যায় তা জানতে
পারছি। কোন শ্রেণির রোগী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে, কারা প্রতিরোধ করবার
শক্তি বেশি রাখে এসব আমরা খুব দ্রুতই জেনে ফেলছি। ফলে এর ভয়াবহতা থেকে
আজকের পৃথিবীর মানুষ নিজেদের রক্ষা করতে পারবে এই আশা করা যেতেই পারে।
আক্রান্তদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে পারলে সংক্রমণ এড়ানো যাবে, এটা জানা
সত্বেও এর সংক্রমণ অতি দ্রুত বেড়েই চলেছে, এটি খুব আশঙ্কার কথা। ৩ এপ্রিল
দিনের শেষে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ এবং মৃতের সংখ্যা ৬৪ হাজার।
মৃতের সংখ্যা পাঁচ শতাংশের কিছু বেশি। স্পেনিশ ফ্লুতে মৃতের সংখ্যা ছিল
দশ শতাংশ। আজকের আধুনিক পৃথিবী মৃতের সংখ্যা আরো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে
পারার কথা ছিল। তাহলে কোথাও কিছু একটা ঘাটতি আছে যা আমাদের প্রত্যাশা পূরণ
করতে পারছে না। কি সেই ঘাটতি? এ যাবৎ যারা মারা গেছেন তাদের সিংহভাগেরই
অন্য কোনো গুরুতর অসুখ ছিল যা তাদের জীবনকে ইতোমধ্যেই ঝুঁকিপূর্ণ করে
রেখেছিল। এ জাতীয় রোগীদের করোনাভাইরাস আক্রমণ করার পরে তাদের মূল অসুখের
সঠিক চিকিৎসা ব্যহত হচ্ছে বলে আমার মনে হয়। ফলে স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি
ঘটছে এবং মৃত্যু হচ্ছে।
চীনের হুবেই প্রভিন্সে গত নভেম্বরে প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী
শনাক্ত হয়। এর মাসখানেকের মধ্যেই উহানে মহামারি আকারে দেখা দেয় করোনা। ১৯
জানুয়ারি আমেরিকার ওয়াশিংটনে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগীর সন্ধান মেলে।
এপ্রিলের ৩ তারিখ, এখনো পর্যন্ত আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান এর প্রতিষেধক
আবিস্কার করতে পারেনি, এটি চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি বড় ব্যর্থতা।
যদি স্পেনিশ ফ্লুর সংক্রমণ মাত্রার ১০ শতাংশও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবে
বলে ধরে নিই, তাহলে ২০ কোটি লোক এই ভাইরাসে আক্রান্ত হবে। খুব দ্রুত
প্রতিষেধক বের করতে না পারলে সংখ্যাটি এর চেয়ে বেশি ছাড়া কম হবার কোনো
সম্ভাবনা দেখছি না।
তখনো চিকিৎসা বিজ্ঞান স্পেনিশ ফ্লুর কোনো প্রতিষেধক আবিস্কার করতে
পারেনি। রোগটি নিজে নিজেই তিন বছর পর পৃথিবী থেকে চলে যায়। এখন সঙ্গত
প্রশ্ন হচ্ছে করোনা কতদিন থাকবে? স্পেনিশ ফ্লুর মতো এটিও কি তিন বছর থাকবে?
যদি প্রতিষেধক আবিস্কার করা না যায় তাহলে যুক্তিযুক্তভাবে এর স্থায়িত্বকাল
বেশ দীর্ঘ হবে বলেই মনে হয়।
এবার যুক্তি এবং বিশ্লেষণ থেকে বের হয়ে আসি। একজন আশাবাদী মানুষের
পয়েন্ট অব ভিউ থেকে করোনা মুক্তির কথা বলি। করোনা নিয়ে আমি একটি কবিতা
লিখেছি কয়েক দিন আগে। সেই কবিতার মূল বিষয় হচ্ছে প্রকৃতি নিজেকে দূষণমুক্ত
করার জন্য করোনা পাঠিয়েছে। এখন রাস্তায় গাড়ি নেই, অফিসে লোক নেই,
ধর্মশালাগুলো শূন্য, অরণ্যে শিকারী নেই। আকাশ তো মেঘের, পাখিদের। সেই
আকাশে হাজার হাজার ধাতব বিমান। প্রতি ঘন্টায় একেকটি বিমান পুড়ছে ৩ হাজার
গ্যালন জ্বালানি তেল। কোটি কোটি টন জ্বালানি তেল পুড়ত প্রতিদিন রাস্তায়,
আকাশে। সেটা বন্ধ হয়েছে। টন টন কাগজে প্রিন্ট হতো অফিসগুলোতে, সেটা বন্ধ
হয়েছে। এভাবে প্রকৃতি নিজেকে শুদ্ধ এবং সুস্থ করে তুলছে। যখন সে মনে করবে
সুস্থ হয়ে উঠেছে তখন নিজেই সে তার সৈন্যদলকে যুদ্ধের ময়দান থেকে তুলে নেবে।
আর একটি আশার কথা বলি। যে কোনো সিজনাল ফ্লুই দুই/তিন মাসের বেশি থাকে
না। গরম পড়লে কোভিড—১৯ ফ্লুও মিইয়ে যাবে। আমার এই বিশ্বাস কিন্তু খুব দৃঢ়।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ৩ এপ্রিল ২০২০।
নিউজ সোর্স- রাইজিংবিডি
লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক, জাতিসংঘে কর্মরত
0 Comments:
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।