সাড়ে তিন কোটি বছর বয়সের মানুষ!


রায়হান আছে বিরাট ঝামেলায়। যখন ইয়াং ছিলো তখন বার্থডে আসলে সবাই উইশ করতো, 'ভাই হাজার বছর বেঁচে থাকেন।'

তো কিভাবে কিভাবে জানি কথা লেগে গেছে। ফ্রেন্ড সার্কেল থেকে শুরু করে আত্মীয় স্বজন, ছোটভাই বড়ভাই সব মরে ভূত কিন্তু রায়হান আর মরে না। দেড়শো বছর পার করে ফেলার পর সে প্রথম রিয়েলাইজ করলো, এইটা তো বিরাট ঝামেলা। নিজের ছোট ছেলে বুড়ো হয়ে বার্ধক্যজনিত কারণে মারা গেলো সেদিন অথচ রায়হান বিন্দাস আছে। নাতি নাতনির বয়সও পঞ্চাশ পার করে ফেলেছে এদিকে তার মরার খবর নাই। সবাই এমনভাবে লুক দেয় যেন সে প্রতারণা করতেছে। স্বার্থপরের মত বেঁচে আছে। দুইশো বছর হওয়ার পর রাইহানকে নিয়ে কিছুদিন টিভি আর পত্রিকায় খুব তোলপাড় হলো। নিউজ টিউজ আসলো। মোটামুটি একটা সেলিব্রেটি টাইপ ভাব৷ তারপর আস্তে আস্তে সেটাও থেমে গেলো। এখন আর পরিচিত কয়জন ছাড়া বাকি কোনো লোক বিশ্বাস করে না। বলে, 'ধুর, ফাপর দিও না। দেইখাই বোঝা যায় বয়স হবে সর্বোচ্চ আশি একাশি। আসছে দুইশো বছরের গল্প নিয়ে।'
যারা এরকম বলে তারাও একসময় পটাপট মরে গেলো। রায়হান তখনো দাত দিয়ে আখ ভেঙ্গে খায়। নাতিপুতির ছেলেরা তাকে সেভাবে দেখতে পারে না৷ তার মরার জন্য সবাই ওয়েট করে থাকে। সে এখন ঠিক কোন নাতির ছেলের ছেলের ঘরে থাকে, তার অতো হিসাবও নাই। তবে যাদের বাড়িই থাকুক না কেন, তারা প্রতিটা দিন রায়হানের মরার জন্য দিন গোণে।

বাড়ির বউ এসে ডেইলি ডেইলি জিজ্ঞেস করে, 'আব্বা, শরীরটা কেমন আজকে? কিছু কি বুঝতেছেন? একটু খারাপ কি লাগে? বুকে ব্যাথা বা শ্বাসকষ্ট এই টাইপ কিছু হয় নাকি!'

রায়হানের কিচ্ছু হয় না, তারপরও তাদেরকে খুশি করার জন্য বলে, 'হ, আজকে একটু শরীরের মধ্যে কেমন কেমন যেন লাগতেছে। মনে হচ্ছে আর বেশিদিন বাঁচবো না।'

অতি সন্তর্পনে বাড়ির মানুষের মুখে হাসি ফুটতে দেখে সে। পাশের রুম থেকে কথা শোনে, 'ওগো খবর শুনছো, গুড নিউজ। বুড়ো এইবার মনে হয় যাবে।'

কিন্তু রায়হান কোথাও যায় না। নাতির ছেলের ছেলে আর তার বউ টুক টুক করে মরে যায়। রায়হান তখনো চশমা ছাড়া পত্রিকা পড়ে খালি চোখে৷ বয়স এখন কত হবে? তিনশো ছাড়ায়ে যাওয়ার কথা৷ গোনে না রায়হান। কতগুলো পুরুষ পার হলো সেটাও আর গোনে না। লাইফটা তার কাছে বড়ই রসকষহীন হয়ে গেছে। আর বেঁচে থাকতে ভালো লাগে না। শুধুমাত্র মহাপাপ বলেই এখনো সুইসাইড করছে না রায়হান।
.
নাতির নাতিপুতিরা রায়হানকে মারার জন্য সরাসরি কিছু না করলেও পরোক্ষভাবে অনেক চেষ্টা করলো। মাহফুজুর রহমানের গান শুনালো, কেকা ফেরদৌসির রেসিপি খাওয়ালো, কান হেলালের ভিডিও আর হিরো আলমের সিনেমা দেখালো। রাবা খানের বই পড়ালো। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না৷ সবকিছু পরাস্ত করে সে বেঁচে রইলো।
.
তার আশেপাশের দুনিয়ায় কতকিছু চেঞ্জ হয়ে গেছে এর মধ্যেই। তাদের জামানায় ফেসবুক ছিলো, এখন আর সেসব চলে না। জাদুঘরে গেলে দেখে আসা যায়। পরে ব্রেইনবুক বলে একটা জিনিস আসছিলো। সবাই সবার ব্রেইনের সাথে কানেক্ট হয়ে কথাবার্তা বলতে পারতো মনে মনেই। সেটাও আস্তে আস্তে ব্যাকডেটেড হয়ে গেল। মানুষের চাইতে দুনিয়ায় রোবট কাজকর্ম করে বেশি। তবে কোনটা মানুষ আর কোনটা রোবট তা বের করা যায় না সহজে। রায়হান এককালে সিনেমার খুব ভক্ত ছিলো, তাদের সময় শাহরুখ, সালমান, জনি ডেপ, টম ক্রুজ বলে কত নায়ক ছিলো। সব বহু আগেই মারা গেছে। তারপর নায়কের কত জেনারেশন চলে গেলো। রায়হান নিজেকে এইসব বাচ্চা নায়কদের সাথে ঠিক মিলাতে পারে না। তার খুবই অস্বস্তি হয়। সিনেমা দেখাও বাদ দিয়ে দিয়েছে সেইজন্য। তবে রায়হান একটা জিনিসে খুব মজা পায়। এককালে এই দেশে যারা ক্ষমতায় ছিলো, ক্ষমতায় থাকার জন্য পিটিয়ে মানুষ মেরে ফেলতো, তাদের আজ নামও কেউ জানে না। বহু আগেই সবাই ধুয়েমুছে গেছে। কই গেছে কে জানে! স্বর্গ নরক কিছু থাকলে তাদের নরকেই যাওয়ার কথা। মানুষের অভিশাপ তো আর কম লাগেনাই। চিন্তা করতেই অন্যরকম এক তৃপ্তি আসে তার।
.
এখন রায়হান যাদের সাথে থাকছে, তারা রায়হানকে বেশ কয়েকবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে৷ ডাক্তার জিজ্ঞেস করে, সমস্যা কি?
তারা কিছুই বলতে পারে না। বলে, 'বডি চেকাপ করাইতে নিয়ে আসছি। একটু দেখেটেখে বলেন কি অবস্থা। মরবে কবে।'
ডাক্তার সব চেক করে বলে, 'আপনার বাবা তো খুব সুস্থ আছে। কোনো সমস্যা নাই।'
তারা মুখ বাকিয়ে বলে, 'আমার বাবা না ইনি।'
ডাক্তার হাসে, তাহলে আপনার দাদা। ইনার শরীর আলহামদুলিল্লাহ অসাধারণ এই বয়সেও।'
তারা আরো বিরক্ত হয়, আমার দাদাও না।
.
তাদের শরীরে নানারকম সমস্যা দেখা দেয়। হার্ট প্রবলেম, হাই প্রেশার, ডায়াবেটিস। অথচ রায়হান এখনো লিফট ছাড়া ছয় তলা হেটে হেটে উঠে পড়ে সিড়ি ভেঙে।
.
রায়হানের বয়সের খবর মিডিয়া এখন জানলে সারাবিশ্বে একটা তোলপাড় সৃষ্টি হয়ে যাবে৷ বিজ্ঞানীরা বিরাট অবাক হবে৷ কিন্তু কেন যেন সে যেই নাতির ঘরের নাতির নাতিপুতিদের সাথে থাকে, তারা পুরো বিষয়টা গোপন করে রেখেছে। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে, বয়স আর কত হবে৷ এই নব্বই পচানব্বই। তারা খুব হিংসায় জ্বলেপুড়ে মরে। তারা চায় না বিশ্বের লোকজন রায়হানকে নিয়ে আগ্রহী হয়ে যাক। রায়হান একা একটা ঘরে সারাদিন থাকে। সকাল আর বিকাল একটু বাসার পাশের গার্ডেনে হাটতে বের হয়৷ এককালে যারা তার সামনে হাফপ্যান্ট পরে দৌড়াদৌড়ি করতো, হাসতো খেলতো, আজ তারা বয়সের ভারে কুজো হয়ে গম্ভীর মুখে পার্কের বেঞ্চে বসে রাজনৈতিক আলাপ আলোচনা করে। একটু বেশি হাটলেই তাদের বুকে চাপা ব্যাথা শুরু হয়। ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ে। অথচ রায়হান এখনো পুরো পার্কে তিন চক্কর দিয়ে এসে ক্লান্ত হয় না।
.
আরো দুইশো বছর যাওয়ার পর দেশ থেকে বিয়েশাদি উঠে গেলো৷ জনসংখ্যা সমস্যার কারণে সরকারিভাবে বাচ্চা নেয়া নিষিদ্ধ করা হলো। সুতরাং সে যেই বাসায় থাকতো তারা মরে যাওয়ার পর রায়হানের আর কোনো আত্মীয় বেঁচে থাকলো না। সে একা একা বের হয়ে পড়লো দুনিয়া ভ্রমনে৷ বিভিন্ন শহরে যায়, ছোটোখাটো কাজ করে নিজের খরচ নিজেই চালায়। এটা একদিক দিয়ে ভালো হইছে তার জন্য৷ কবে মরবে, সেই প্রশ্ন করার আর কেউ নেই।
.
এক হাজার বছর পার হয়ে গেলো কিন্তু রায়হানের কিছুই হলো না। মানুষ নিজেদের মধ্যে মারামারি করে, প্রকৃতির উপর অত্যাচার করে করে আস্তে আস্তে ধ্বংস হওয়া শুরু করলো। শহরের পর শহর উজাড় হতে থাকলো। কখনো কঠিন কোনো রোগ আসে যার কোনো চিকিৎসা নাই, কখনো বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। একবারে লাখ লাখ মানুষ মারা যায়। কিন্তু যথারীতি বেঁচে থাকে রায়হান।
.
আরো দুইতিন হাজার বছর পর পৃথিবীর সভ্যতা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেলো। মানুষ আবার আদীম যুগে ফিরে গেলো। বন জঙ্গলে থাকে আর শিকার করে খায়। তখন মানুষ মারা যেতে থাকলো বিভিন্ন পশুর আক্রমনে। কিন্তু মরলো না রায়হান।
.
আরো পঞ্চাশ বছর পর সভ্যতা আবারো ঠিকঠাক হলো। গুহা ছেড়ে মানুষ নিজেদের জন্য ঘর বানালো। হিংস্র পশুদের মারার জন্য অস্ত্র বানালো। রায়হান তাদের সাথেই আছে। এর মধ্যে তাকে দুইবার বিয়ে দেয়া হয়েছে। নতুন বাচ্চাকাচ্চাও হয়েছে তার। নিজের ভেতরের এনার্জি দেখে সে নিজে যেমন অবাক, তেমনি তার থেকে দুই লাখ বছরের ছোট বউদুজনও অবাক।
.
এভাবেই কেটে গেলো আরো কয়েক লাখ বছর৷ তারপর এক শুভ দিন দেখে দুনিয়া ধ্বংস হয়ে গেলো। সারা পৃথিবী ভেঙেচুরে গুড়াগুড়া। সব উল্টেপাল্টে গেলো। জীবিত সমস্ত প্রাণী মারা গেলো। কিন্তু রায়হানের কিছুই হলো না। সে একা একা বেঁচে রইলো।
.
ওদিকে বিচারকার্য শুরু হলো৷ সব মানুষ তাদের কর্মফল অনুযায়ী প্রাপ্য পেলো। কেউ স্বর্গে গেলো, কেউবা নরকে৷ একা একা রায়হান দুনিয়ায় ঘুরতে লাগলো। সে মরেনাই জন্য বিচারের আওতার বাইরে থাকলো। স্বর্গেও তারে ঢুকতে দেয় না, নরকেও যায়তে দেয় না। কোথাও জায়গা না পেয়ে সে বিরক্ত হয়ে সুইসাইড করার সিদ্ধান্ত নিলো৷
.
একটা কাচের টুকরা জোগাড় করে কবজির রগ কেটে দিলো। ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়া শুরু হলো৷ শরীর আস্তে আস্তে দূর্বল হওয়া শুরু করলো। শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। মৃত্যুভয় ঢুকলো রায়হানের মনে। সে দ্রুত একটা কাপড় এনে ক্ষতস্থান বেধে রক্ত বন্ধ করে ফেললো।
'নাহ এতো দ্রুত মরা যাবে না। আরো কিছুদিন বাঁচতে হবে। তাছাড়া তার কিই বা এমন বয়স হয়েছে। সাড়ে তিন কোটি বছরের বেশি তো আর না!'

লেখা: সোহাইল রহমান

SHARE THIS

Author:

0 Comments:

আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।