যে গল্পে তুমি নেই - শেষ পর্ব

 
বাসা থেকে বের হয়ে একটা নির্জন জায়গায় গিয়ে বসে রইলাম। বসে বসে কান্না করতেছি এমন সময় কেউ একজন আমার কাঁধে হাত রাখে। পেছনে তাকাতেই দেখি রাশেদ আর জলিল।

রাশেদঃ কিরে তুই এখানে? আমরা তোকে অনেক খুঁজেছি।
আমিঃ…….
জলিলঃ চল এখন।
আমিঃ কোথায়?
জলিলঃ বাসায়।
আমিঃ না আমার কাজ আছে, তোরা যা।
রাশেদঃ মন খারাপ করে বসে থেকে লাভ আছে? ফ্যামিলিতে একটু সমস্যা হয় এটা কোনো ব্যাপার না।
আমিঃ তোদের কে বলেছে?
রাশেদঃ আন্টি কল করে সব বলেছে। তুই বাসায় চল।
আমিঃ না আমি জীবনেও আর ওই বাসায় যাবো না।
রাশেদঃ দেখ তুই পাগলামি করিস না, চল বাসায় চল।
আমিঃ বললাম তো আমি যাবো না।
রাশেদঃ তো তুই কোথায় যাবি?
আমিঃ আমাকে তোদের চিন্তা করা লাগবে না। তোরা যা,,,,
রাশেদঃ সত্যিই যাবি না?
আমিঃ না।
জলিলঃ কি করবি তাহলে?
আমিঃ জানি না, তবে এটা সিউর থাক যে আমি আর বাসায় যাচ্ছি না।
রাশেদঃ পড়ালেখার কি হবে?
আমিঃ জানি না। করবো না আর, করে লাভ কি?
জলিলঃ দেখ এই সামান্য ঘটনার জন্য পড়ালেখা বন্ধ করিস না, তুই তোর ফ্যামিলিকে দেখিয়ে দে। তোর ভাবিকে বুঝিয়ে দে যে তাদের ছাড়াও তুই প্রতিষ্ঠিত হতে পারিস।
রাশেদঃ আচ্ছা এখন আমার সাথে আমাদের বাসায় চল। কি করবি সেটা পরে দেখা যাবে।
জলিলঃ হুম সেটাই চল।



তারপর রাশেদের বাসায় চলে গেলাম।
রাতে আমি রাশেদ আর জলিল ওদের ছাদের উপর বসে আছি বার বার নিশিতার কথা মনে পড়তে লাগলো।
জলিলঃ তুষার!
আমিঃ হুম বল।
জলিলঃ একটা কাজ কর।
আমিঃ কি?
জলিলঃ নিশিতাকে উঠিয়ে নিয়ে আয়। তারপর বিয়ে কিরে নে।
আমিঃ নারে নিশিতা ওর আব্বু আম্মুর উপরে কথা বলবে না। আর নিশিতাকে আমি নিয়ে আসলে ভাইয়া আর ভাবির ডিভোর্স হয়ে যাবে।
জলিলঃ তাহলে কি করবি?
আমিঃ দোস্ত আমি ওরে ছাড়া থাকতে পারমু না।
জলিলঃ তুই বাসায় ফিরে যা, দেখবি সব মেনে নিবে।
আমিঃ না, আমি ওয়াদা করেছি আমি ওই বাড়িতে গেলেও থাকবো না, শুধু আব্বু আম্মু ছাড়া কারো সাথে আর কথা বলবো না। যদিও যাই এক ফোটা পানিও খাবো না।
জলিলঃ তুই একটা কাজ কর।
আমিঃ কি?
জলিলঃ তুই চট্টগ্রাম চলে যা।
আমিঃ কেন?
জলিলঃ ওখানে গিয়ে পড়ালেখাটা শেষ কর, নিশিতার বয়স এখনো বেশি হয়নি। তুই ভালো কোনো চাকরি পেলে এমনিতেই তোর কাছে বিয়ে দিবে।
রাশেদঃ হুম এটাই কর। আমার কয়েকটা ফ্রেন্ড ওখানে আছে। ওদের সাথে থাকবি পড়ালেখা করবি। আমি ওদের বলে দেবো যাতে তোর জন্য একটা চাকরি দেখে বা কয়েকটা টিউশনি দেখে যা খরচটা অন্তত চালাতে পারিস।

আমিঃ ওকে, তাহলে তুই কথা বল।
রাশেদঃ আচ্ছা ঠিক আছে।
পরেরদিন আমি রাশেদ আর জলিল চট্টগ্রাম চলে গেলাম। সেখানে সোহাগ, শাহিদুর আর শোয়াইব  নামের ৩ টা ছেলে আমাদের নিতে আসলো। পরে জানলাম এরাই রাশেদের বন্ধু।

অবশেষে ওদের সাথে ব্যাচেলর উঠে গেলাম। আব্বু আম্মুর জন্য মন খারাপ থাকতো সব সময়। রাশেদ আর জলিল আমাকে রেখে আবার নোয়াখালীতে চলে আসে। ওদের সাথে মোবাইলেই কথা হয়। মাঝেমাঝে আম্মুর সাথে কথা হয়, এভাবেই দিন যাচ্ছিলো। সোহাগ  শোয়াইবও আমাকে খুব ভালো বন্ধু হিসেবে দেখে। কয়েকটা টিউশনি করিয়েই দিন যাচ্ছে।

হঠাৎ একদিন জলিল কল দিয়ে বললো নিশিতার বিয়ে হয়ে গেছে। আমাকে জানায়নি কারন আমি জানলে নাকি সমস্যা করতাম। জলিলও শুনেছে বিয়ের কয়েকদিন পর। ইচ্ছা করছে উড়ে নিশিতার কাছে চলে যাই কিন্তু পারলাম না। নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলাম না। ফ্যামিলি এতো বড় গাদ্দারি করবে কখনো কল্পনা করিনি। আম্মুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আম্মু বলেছে তারাও নাকি বিয়েতে যায়নি। শুধু ভাইয়া আর ভাবি গিয়েছিলো। 

আর বিয়েটা ভাবিই দিয়েছে। কিছু বললাম না আর!!!
সেদিন অনেক গুলো ঘুমের মেডিসিন খেয়ে ফেলি নিজেকে সারা জীবনের জন্য ঘুমানোর জন্য কিন্তু সেটাও পারলাম না।
সোহাগ, শোয়াইব, শাহিদুর তাড়াতাড়ি আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়, অল্পের জন্য বেঁচে যাই।

পরে রাশেদ আর জলিলও আসে, কোনো কথা না বলে দুজনেই আমার গালে ঠাসস করে চড় বসিয়ে দেয়। তারপর জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে। আমার চোখ দিয়েও পানি ঝরতে লাগলো। রাশেদ আর জলিল ২ দিন থেকে আবার ব্যাক করলো। আমি সব সময় মন খারাপ করে বসে থাকতাম।

কিছুদিন পর আম্মু কল দেয়….
আম্মুঃ কেমন আছিস?
আমিঃ ভালো, তোমরা?
আম্মুঃ আছি।
আমিঃ আব্বু কোথায়?
আম্মুঃ পাশে আছে। শোন তোকে একটা কথা বলার জন্য কল করেছি।
আমিঃ হুম বলো।
আম্মুঃ তোর ভাইয়ের মেয়ে হয়েছে, তুই কাকা হয়েছিস।
আমিঃ সরি তুমি ভুল বলছো। আমার কোনো ভাই নেই।
আম্মুঃ প্লিজ এভাবে বলিস না। যা হওয়ার হয়ে গেছে, এবার অন্তত বাড়িতে আয়।
আমিঃ নাহ, অন্য কথা থাকলে বলো।
আম্মুঃ অন্তত ছোট্ট মেয়েটাকে দেখে যা।
আমিঃ আমার সময় নাই, কখনো সময় ফেলে আসবো।
এ কথা বলে কল কেটে দিলাম। 

আম্মু কান্নাকাটি করলো বাট আমি যাইনি। এভাবে মাস শেষ হয়ে বছরও শেষ আমি আর বাসায় যাইনি। নিশিতার জন্য এখনো আমি কান্না করি। সত্যিই অনেক ভালো বাসতাম মেয়েটাকে। কিন্তু মেয়েটাও স্বার্থপর, ওর জন্য ঘর ছাড়া হলাম কিন্তু খুব সহজেই অন্য কাওকে বিয়ে করে নিলো। একবারও ভাবলো না আমার কথা।

প্রায় ২ বছর পর, আমি অনার্স শেষ করে মাস্টার্সে ভর্তি হলাম। ছোট একটা চাকরিও পেলাম, মাসে মাসে আব্বু আম্মুর জন্য টাকা পাঠাই যাতে ভাবি আব্বু আম্মুকে কিছু বলতে না পারে।

একদিন আব্বু কল দিলো। এমনিতে আব্বুর সাথে তেমন কথা বলি না, বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর একদিন বলেছি তাও ভুলে। আর আজকে আব্বু নিজেই কল দিয়ে বললো আম্মু নাকি অনেক অসুস্থ, শেষ বারের মতো আমাকে দেখতে চাইছে। আব্বুর কথা শুনে নিজেকে স্থির রাখতে পারিনি, ব্যাগপত্র ঘুছিয়ে নোয়াখালীর দিকে রওনা দিলাম।

অবশেষে নোয়াখালী চলে আসলাম, রাশেদ আর জলিল আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলো তারপর ওদের কে সাথে নিয়ে বাসার দিকে পা বাড়ালাম, কিন্তু ওরা গেলো না। কলেজে কি একটা কাজ আছে নাকি, ওরা কলেজে চলে গেলো, আমি বাসার দিকে রওনা দিলাম।

ঘড়ির দিকে তাকালাম দেখি ১১ টা বাজে, একটা হোটেলে গিয়ে দুপুরের খাওয়ার টা প্যাকেট করে নিলাম। সাথে কয়েক বোতল পানি নিলাম। আব্বু আম্মুর জন্য কিছু জিনিস নিয়ে আর ভাইয়ার মেয়ের জন্য কয়েক প্যাকেট চকলেট নিয়ে বাসায় গেলাম।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম!!  কি রকম অস্বস্তি লাগছে!! শরীর কাঁপছে। কাঁপা কাঁপা শরীর নিয়ে কলিংবেল চাপ দিলাম। ভিতর থেকে কেউ বললো দরজা খোলাই আছে, আমি ভিতরে গেলাম। ছোট একটা পরিকে দেখে আমার চোখ আটকে গেলো। পরীটা আর কেউ নয় আমার ভাইয়ের মেয়ে। চেহারাটা একদম ভাইয়ার মতো।

পরীঃ কে গো তুমি? (বাহ! কথাও বলতে পারে)
আমিঃ তুমি কে, তোমার নাম কি?
পরীঃ আমার নাম তমা। তুমি কে?
আমিঃ আমি তোমার চাচ্চু।
তমাঃ তুমিই সেই যার জন্য দাদু প্রতিদিন কাঁদে? যাও তুমি পচা, তোমার সাথে কথা নাই।
আমিঃ ওলে ওলে বাবুটা রাগ করে দেখতেছি, এটা বলেই তমাকে কোলে তুলে নিলাম। তারপর চকলেট গুলো ওর হাতে দিলাম। ওরে কোলে নিয়ে আম্মুর রুমে গেলাম। আম্মু আমাকে দেখেই কাঁদতে শুরু করলো। আমি গিয়ে সালাম করবো এমন সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে সেকি কান্না, মা তো ছেলের কষ্ট সহ্য করতে পারে না। আমিও মাকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম কিছুক্ষণ।

মা আগের মতো নাই, শরীর পুরো ভেঙ্গে গেছে। আমি মায়ের পাশে বসে আছি, তমা আমার কোলে। এমন সময় আব্বু রুমে আসলো। আব্বুর চোখেও স্পষ্ট পানি দেখতে পেলাম, আব্বুও প্রায় কেঁদে দিলো। অনেকক্ষণ পর ভাবি আসলো, আমি এসেছি যে হয়তো জানে না। আম্মুর রুমে কান্নাকাটির আওয়াজ শুনে আসলো।

ভাবি আমাকে দেখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো, কিছু বলতে যাবে তার আগেই আমি উঠে তমাকে কোলে নিয়ে ছাদে চলে গেলাম। মেয়েটা অনেক মিষ্টি, একদিনেই মন জয় করে নিলো। কিছুক্ষণ ছাদে থেকে নিজের রুমে গেলাম। সেই সব কিছুই আগের মতো আছে। পুরোনো স্মৃতিগুলোর কথা মনে করে আমারও চোখের কোনে পানি জমা হলো। তারপর আম্মুর কাছে গেলাম, গিয়ে আম্মুর পাশে বসে বসে কথা বলতেছি এমন সময় ভাবি আসলো সবাইকে খাওয়ার জন্য ডাকছে।
আম্মুঃ চল খেতে চল।
আমিঃ আমি খাবার নিয়ে আসছি। তোমারাও আমার সাথে খাও।
আম্মুঃ কি বলিস, কোথায় থেকে আনলি?
আমিঃ হোটেল।

তারপর ব্যাগ থেকে খাবার বের করে আমি, আব্বু, আম্মু খেয়ে নিলাম। তমাকেও খাইয়ে দিলাম। ভাবি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইলো, তারপর নিজের রুমে চলে গেলো। বিকালবেলা আমি চলে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছি এমন সময় আব্বু বললো…
আব্বুঃ কোথায় যাচ্ছিস?
আমিঃ চলে যাচ্ছি।
আম্মুঃ কয়েকটা দিন থেকে যা।
আমিঃ মা আম্মু, কাজ আছে।
আব্বুঃ আজকের রাত টা থেকে যা।
আম্মুঃ প্লিজ বাপ না করিস না।
আমিঃ আচ্ছা।
বিকালবেলা বের হয়ে রাশেদ আর জলিলের সাথে আড্ডা দিলাম। মনটা একদম ফ্রেশ হয়ে গেলো। রাতে বাসায় যাওয়ার সময় রাশেদ আর জলিলকেও নিয়ে গেলাম। কারন আমি ওই বাসায় থাকবো না, বিদায় নিয়ে চলে আসবো তাই। বাসায় গেলাম, রাশেদ আর জলিল আম্মুকে দেখলো। কথা বললো, তমা এসে আমার কোলে উঠে গেলো।

কিছুক্ষণ পর ভাইয়া আসলো। আমি আম্মুর কাছেই ছিলাম। আমাকে দেখে দৌড় দিয়ে আসতে যাবে এমন সময় আমি মোবাইলটা কানে লাগিয়ে উলটো দিকে হাটা দিলাম। ভাইয়া নিশ্চিত বুঝেছে আমি ওর সাথে কথা বলবো না। ভাইয়ার সাথে ভাবিও ছিলো, আমি মোবাইলটা কানে লাগিয়ে জলিলের কাছে চলে আসলাম।

ভাইয়াও আসলো….
ভাইয়াঃ কি অবস্থা তোমাদের?
রাশেদঃ জ্বি ভাইয়া ভালো।
ভাইয়াঃ আজকে সবাই খেয়ে যাবে।
জলিলঃ আসলে ভাইয়া আম্মুকে বলে এসেছি, আম্মু অলরেডি খাবার রেডে করে ফেলেছে।
ভাইয়াঃ না এতো কথা আমি শুনবো না, আজকে খেতেই হবে।
ওরা আর কিছু বললো না, আমি মোবাইলটা আবারও কানে লাগিয়ে বাইরে চলে গেলাম।
বাইরে গিয়ে হোটেল থেকে খাবার নিয়ে বাসায় গেলাম।
আমার রুমে আমরা ৩ জন বসে আছি এমন সময় ভাবি আসলো, খাওয়ার জন্য ডাকছে।
ওরা উঠে গেলো, আমাকেও উঠালো।
আমি প্যাকেট টা হাতে নিয়ে ওদের সাথে ডাইনিং রুমে গেলাম।
ভাবি মনে করেছে আমিও খাবো তাই সবার আগে আমাকেই ভাত দিয়েছে কিন্তু আমি ওগুলো দূরে ঠেলে দিয়ে প্যাকেটটা খুলে প্যাকেটের উপর রেখেই খাওয়া দিলাম।
সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
আব্বু আম্মু আর খেলো না, ভাইয়াও রেখে উঠে গেলো।
তারপর রুমে এসে রেডি হয়ে নিলাম। 

সব কিছু নিয়ে বের হবো এমন সময় দেখি তমা নেই, মনে হয় ঘুমিয়ে গেছে। আব্বু আম্মুকে সালাম করে বেরিয়ে পরলাম, আম্মু কান্না থামাচ্ছেই না, ভাইয়া আর ভাবি এক কোনে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর বেরিয়ে জলিলদের বাসায় চলে গেলাম, রাতটা ওখানে থেকে পরের দিন আবার চট্টগ্রাম চলে গেলাম।

এরপর থেকে আম্মুর সাথে মোবাইলে কথা হয়, ভাইয়া নাকি সেদিন ভাবিকে অনেক বকাঝকা করেছে আমার পিচ্ছি আম্মুটা বললো। পিচ্ছিটার সাথে প্রতিদিনই আমার কথা হয়। এভাবেই দিন যাচ্ছে, মাস শেষ হয়ে বছর। আমি মাস্টার্স কমপ্লিট করলাম, একটা কোম্পানির এমডি হলাম।
চাকরি বাকরি সব কিছু ভালো ভাবেই যাচ্ছে।

সময় পেলেই আমি মাইজদি  পৌর পার্কে ঘুরি কারন নিশিতাকে নিয়ে আমি প্রায়  পৌর পার্কে ঘুরতাম। আর এই পার্কে নিশিতা আমাকে প্রথম  ভালোবাসি কথাটা বলেছিল। এই পার্কে আসলেই নিশিতার সাথে কাটানো মূহুর্ত গুলো অনুভব করতে পারি। আজকেও ঘুরতেছি এমন সময় নিশিতার সাথে পার্কে ধাক্কা খেলাম (১ম পর্বে বলেছি, তারপর নিশিতার আর আমার ঘটনাটা বললাম)।

রাতের বেলা আর ঘুম হয়নি, বার বার নিশিতার কথা মনে পড়তে লাগলো। সকালবেলা রেডি হয়ে অফিসে গেলাম। একজন কর্মকর্তা আসলো নাম জসিম।
জসিমঃ স্যার আসবো?
আমিঃ হুম আসেন। কিছু বলবেন?
জসিমঃ জ্বি স্যার একটা কথা বলার ছিলো।
আমিঃ জ্বি বলুন।
জসিমঃ স্যার আমার কয়েকদিন ছুটি লাগবে।
আমিঃ কয়দিন??
জসিমঃ স্যার ৩ দিন হলে হবে।
আমিঃ আচ্ছা ঠিক আছে।
জসিম চলে গেলো,এমন সময় আম্মু কল দিলো,কিছুক্ষণ কথা বললাম।
তারপর তমা মোবাইলটা নিয়ে কথা বলতে শুরু করলো, পরীটার কথা শুনে মন ফ্রেশ হয়ে গেলো। পরীটার নাকি জন্মদিন পরশুদিন আমি না গেলে কেক কাটবে না।
তাই আমিও রাজি হয়ে গেলাম।

পরেরদিন আমি অফিস করে রাতের বেলা রওনা দিলাম, রাত ১১ টায় বার্থডে পালন হবে। অলরেডি চট্টগ্রাম থাকতে ৮ টা বেজে গেলো। ড্রাইভারকে বললাম তাড়াতাড়ি চালাতে। আমি নোয়াখালীতে নেমে নোয়াখালী সুপার মার্কেট থেকে অনেক গুলো গিফট, একটা বড় কেক, আব্বু আম্মুর জন্য কাপড় চোপড় নিলাম।।

রাশেদ আর জলিলকেও আসতে বললাম, ওরাও আসলো, তারপর ওদের নিয়ে বাসায় দিকে রওনা দিলাম। বাসায় যেতে ১১.৪০ বেজে গেলো। তাড়াতাড়ি কলিং বেল চাপ দিলাম আর সাথে সাথেই একটা টাসকি খেলাম। কারন দরজা খুলে দিয়েছে নিশিতা।



আমি কিছুক্ষনের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম। তারপর জলিলের ধাক্কা খেয়ে বাস্তবে ফিরে আসলাম। ভিতরে গেলাম, শুধু আব্বু আম্মুকে সালাম করলাম আর তাদের সাথে কথা বললাম। ভাইয়া, ভাবি, নিশিতার আব্বু আম্মু কারো সাথে কথা বললাম না। সবাই আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে হয়তো ভাবছে এতোটা পরিবর্তন কি করে সম্ভব।

তমা একটা লাফ দিয়ে আমার কোলে উঠে গেলো। একটু পর ভিতরের রুম থেকে জসিম আসলো, মানে আমার অফিসের কর্মচারী। 

আমাকে দেখেই…..
জসিমঃ স্যার আপনি এখানে?
আমিঃ আরে জসিম সাহেব যে।
জসিমঃ জ্বি স্যার। স্যার আপনি এখানে আসলেন কি করে?
আমিঃ ওই যে আমার আব্বু আম্মু। (শুধু আব্বু আম্মুকে দেখিয়ে দিলাম)
জসিমঃ ওহ তাহলে তো আপনি আমার আত্নীয়।
আমিঃ হয়তো, আপনি কার কি হন?
জসিমঃ জ্বি আমি আপনার ভাইয়ের ভায়েরা ভাই। মানে নিশিতার হাসবেন্ড।

কথাটা শুনে মনটা কেঁপে উঠলো, নিশিতা  নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো।
নিশিতার আব্বু বললো….
আংকেলঃ জসিম তুমি ওকে কি করে চেনো?
জসিমঃ আরে বাবা কি বলেন! উনিই তো আমাদের কোম্পানির এমডি, আমাদের স্যার। অনেক ভালো মানুষ। আংকেল নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর আমি জসিমকে বললাম অনুষ্ঠান শুরু করার জন্য। অন্য কাওকে কিছু বলিনি।

নিশিতার দিকে যতবার তাকাচ্ছি ততবার আমার কলিজা ফেটে যাচ্ছে

তারপর কেক কাটলো, তমা সবার আগে আমাকে খাইয়ে দিলো, আমিও শুধু তমাকে খাইয়ে দিলাম। তমা একে একে সবাইকে খাইয়ে দিলো, সবাই তমাকে খাইয়ে দিলো। ভাইয়া বার বার আমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে চাইলেই আমি অন্যদিকে তাকিয়ে থাকি। কেক কাটা শেষে আমি তমার হাতে সব গুলো গিফট তুলে দিলাম। তারপর আম্মু আব্বুর জন্য নিয়ে আসা জিনিসগুলো উনাদের হাতে দিলাম।

দেখলাম সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে তাই আমি আম্মুর রুমে চলে গেলাম। আম্মু আব্বুও আমার পিছু পিছু আসলো
আম্মুঃ আজকেও ওদের সাথে কথা বলবি না, এতো পাষাণ হয়ে গেছিস?
আমিঃ আমার কোনো ভাই নেই, শুধু তুমি আব্বু আর তমা ছাড়া।
আম্মুঃ তো তমা কোত্থেকে আসলো তাহলে?
আমিঃ……
একটু পর তমাও আসলো, এসে আমার কোলে উঠে গেলো। হঠ্যাৎ করেই চোখ পড়লো আম্মুর খাটে একটা বাচ্ছার দিকে, কি সুন্দর ফুটফুটে বাচ্ছা। দেখে মনে হচ্ছে একটা জান্নাতি হুর ঘুমিয়ে আছে।

আমিঃ এই বাচ্ছাটা কার?
তমাঃ আরে এটা আমার খালাতো বোন, নিশিতা আন্টির মেয়ে।
কথাটা শুনে আরো একটা ধাক্কা খেলাম। মাত্র ৫ বছরে সব কিছুই চেইঞ্জ হয়ে গেছে। না আর এখানে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। আমার শরীর কাঁপতেছে। আম্মুকে বললাম আমি চলে যাচ্ছি অনেকবার থাকতে বলেছে বাট থাকিনি। আম্মুর রুম থেকে বের হয়ে দেখি রাশেদ, জলিল আর আমার ড্রাইভার খাওয়ার জন্য ডাইনিং এর দিকে যাচ্ছে।

আমিঃ লিটন ভাই (ড্রাইভার) চলেন, আমরা চলে যাবো।
রাশেদঃ আরে ভাবি তো আমাদের খেতে ডাকছে।
আমিঃ বাইরে খেয়ে নিবো। চল,,,,
জলিলঃ কিন্তু সবাই তো একসাথে খাবে এখানে।
আমিঃ আচ্ছা ঠিক আছে তোরা খেয়ে বাসায় চলে যাস। আমি যাচ্ছি, লিটন ভাই আসেন।
রাশেদঃ না দাঁড়া, আমরাও আসছি।
আমিঃ ওকে আয়, আপনি গিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেন। লিটন ভাই বাইরে চলে যায়, আমি আব্বু আম্মুকে সালাম করে নিলাম,
সবার দিকে একবার তাকালাম, ভাইয়ার চোখে পানি টলোমলো করছে, নিশিতা ছাড়া আর বাকিরা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। তমা এসে আমার কোলে উঠে যায়।

তমাঃ চাচ্চু, ও চাচ্চু তুমি কোথায় যাচ্ছো? আমাদের সাথে থাকতে পারো না।
আমিঃ না আম্মু আমার থাকার কোনো যোগ্যতা নেই, আমি ফ্যামিলিতে টাকা দিতে পারবো না। আমি হচ্ছি কুলাঙ্গার,
ফালতু ছেলে। আমি এখানে থাকলে তুমিও খারাপ হয়ে যাবে।
তমাঃ তুমি তো আমার ভালো চাচ্চু। ওরা সবাই পচা। 
আমি তমার মুখে একটা পাপ্পি দিয়ে ওকে নিয়ে বাইরে যাই, সবাই হয়তো বুঝে গেছে আমার কথার মানে। জসিমও বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছে। তমাকে নিয়ে বাইরে গেলাম, আমার পিছু পিছু সবাই আসলো।
রাশেদ আর জলিলকে গাড়িতে উঠতে বললাম। তমার হাতে কতো গুলো টাকা দিয়ে তমাকে আম্মুর কোলে দিয়ে শেষ বারের মতো সবার দিকে তাকিয়ে গাড়িতে উঠে গেলাম। লিটন ভাই গাড়ি টান দিলো। আম্মু কান্না শুরু করলো। আমারও চোখ দিয়ে পানি ঝরতে লাগলো কিছুদূর গিয়ে আমরা একটা হোটেলে খেয়ে নিলাম, রাশেদ আর জলিলকে বিদায় দিয়ে আবার চট্টগ্রাম এর দিকে রওনা দিলাম।

গাড়ি চলছে তার আপন মনে, আমি হারিয়ে গেছি ফেলে আসা সেই অতীতে। হয়তো আজকে আমারও খুব সুন্দর একটা ফ্যামিলি থাকতো। আমিও অন্য দশজনের মতো থাকতে পারতাম। সামান্য একটা চাকরির জন্য হারালাম নিজের ভালোবাসাকে, ছেড়ে দিলাম ফ্যামিলিকে। সব কিছু থেকেও অনাথ, হয়তো আজকে আমিও নিশিতা কে নিয়ে অনেক সুখে থাকতাম। স্বপ্ন দেখতাম অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার। কিন্তু নিয়তি কোথায় থেকে কোথায় নিয়ে যায় সেটা কেউ বলতে পারে না। সবার ভাগ্যে সব কিছু থাকে না। সব কিছুর সমাপ্তি নেই, কিছু গল্প অসমাপ্ত থেকে যায়। তবুও ভালো থাকুক প্রিয় মানুষ গুলো।

সবার সব কিছু থাকুক পূর্ণ, হয়তো আমার গল্পে তুমি নেই, আমার জীবন নাহয় থাকবে দুঃখে পরিপূর্ণ, এটাই আমার অসমাপ্ত ভালোবাসার গল্প।


******** সমাপ্ত ********

SHARE THIS

Author:

0 Comments:

আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।